logo
খবর

জুলাই–আগস্টে আন্দোলন চলাকালে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে: জাতিসংঘের প্রতিবেদন

প্রতিবেদক, বিডিজেন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Copied!
জুলাই–আগস্টে আন্দোলন চলাকালে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে: জাতিসংঘের প্রতিবেদন
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশের সাবেক সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য ও অন্য প্রমাণের ভিত্তিতে এটি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী ও সহানুভূতিশীলদের আক্রমণ ও সহিংসভাবে দমন করার একটি সরকারি নীতিও খুঁজে পেয়েছে। যা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। এসবের জন্য আরও জরুরি ফৌজদারি তদন্ত প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভ দমনে সরাসরি জড়িত সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অন্য অভ্যন্তরীণ সূত্র বর্ণনা করেছে কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বড় আকারের অপারেশন পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করেছিলেন। সেসময় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা এবং নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছিল।

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশিত মৃত্যুর খবরের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে যে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। অধিকাংশই নিহত হয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশই শিশু। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে বাতিল হওয়া কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের উচ্চ আদালতের রায়ের পর এই বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল। তবে এর মূলে ধ্বংসাত্মক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের ব্যাপক অভিযোগও ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতায় থাকার জন্য আগের সরকার ক্রমবর্ধমান সহিংস উপায়ে এই বিক্ষোভ দমনে ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতিগত চেষ্টা করেছিল।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার টুক বলেন, ‘ব্যাপক বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাবেক সরকারের একটি পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত কৌশল ছিল— যা নিষ্ঠুর প্রতিক্রিয়া।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিক্ষোভ দমনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের পরামর্শ, সমন্বয় ও নির্দেশনা দিয়ে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, আটক ও নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।’

ফলকার টুক বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছি তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও লক্ষ্যবস্তু হত্যার একটি বিরক্তিকর চিত্র উঠে এসেছে। মানবাধিকারের সবচেয়ে গুরুতর লঙ্ঘনগুলোর মধ্যে একটি এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধও হতে পারে। জাতীয় স্বস্তি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার অপরিহার্য।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস বাংলাদেশে ভয়াবহ ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় তদন্তে একটি স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম পাঠায়। তদন্ত দলে একজন ফরেনসিক চিকিৎসক, একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ও একজন মানবাধিকার তদন্তকারী ছিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকার তদন্তে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করেছে। তদন্তের জন্য যেসব সুবিধা অনুরোধ করা হয়েছিল, তা মঞ্জুর করেছে এবং যথেষ্ট প্রমাণপত্র সরবরাহ করেছে।

প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে ও বেআইনিভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার প্রমাণ পেয়েছে। যার মধ্যে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে লোকজনকে গুলি করার ঘটনাও রয়েছে।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলাকালে আবু সাঈদ পুলিশের দিকে খালি হাত উঁচিয়ে ‘আমাকে গুলি করো; বলে চিৎকার করার ঘটনাটিও বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করে এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও জিও-লোকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্তকারীরা কীভাবে এটি ঘটেছিল তার সাক্ষ্যের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য এই হত্যাকাণ্ডটি তদন্ত করেছে।

একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, তার আঘাতগুলো প্রায় ১৪ মিটার দূরত্ব থেকে ধাতব ছররা বোঝাই শটগান দিয়ে কমপক্ষে ২ বার গুলি করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

প্রথম দিকের বিক্ষোভের পুরোভাগে থাকার কারণে প্রতিবাদী নেতাসহ নারীরাও নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার এবং হামলার শিকার হয়েছিলেন।

প্রতিবেদনে নারীদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের হুমকিসহ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নথিভুক্ত করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের হত্যা ও পঙ্গু করে দিয়েছে। তারা নির্বিচারে গ্রেফতার, অমানবিক পরিস্থিতিতে আটক ও নির্যাতন চালিয়েছে। বেশ কয়েকটি মারাত্মক ঘটনার মধ্যে একটি হলো- ধানমন্ডিতে ১২ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী প্রায় ২০০ ধাতব ছররা গুলির আঘাতে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে মারা গেছে।

নিহতদের মধ্যে খুব ছোট শিশুও ছিল। শিশুগুলো তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বিক্ষোভে গিয়েছিল কিংবা যারা পথচারী হিসেবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে একটি বিক্ষোভে সহিংস সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করার সময় ৬ বছরের এক মেয়ে ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে।

৫ আগস্টের বিক্ষোভের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে মারাত্মক দিনগুলোর মধ্যে একটি ঘটনা হলো, আজমপুরে পুলিশের গুলিতে ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। ওই ছেলে বলেছে, সেসময় পুলিশ চারদিকে বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল। সে অন্তত এক ডজন মানুষের মৃতদেহ দেখেছে বলে জানিয়েছে।

প্রতিবেদনে এমন ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী গুরুতর আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকার করেছে বা বাধা দিয়েছে। রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং হাসপাতালে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে। চিকিৎসা কর্মীদের ভয় দেখিয়েছে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করেছে।

এই প্রতিবেদনে আগের সরকার দেশের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলে আওয়ামী লীগের কর্মী–সমর্থক, পুলিশ ও গণমাধ্যমকে লক্ষ্য করে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড ও অন্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার উদ্বেগজনক উদাহরণও নথিভুক্ত করা হয়েছে।

হিন্দু, আহমদিয়া মুসলমান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিল।

বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় প্রায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেলেও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এ ধরনের গোষ্ঠীর ওপর হামলার অপরাধীরা এখনো দায়মুক্তি ভোগ করছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের সংস্কার, নাগরিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ দমনের জন্য পরিকল্পিত দমনমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধনের জন্য বিস্তারিত সুপারিশও করা হয়েছে।

হাইকমিশনার ফলকার টুক বলেন, ‘বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো- সত্য বলা, আহতদের সুস্থতা নিশ্চিত করা ও জবাবদিহিতার একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়ার অনুসরণ। এর মাধ্যমে এই সময়কালে সংঘটিত ভয়াবহ অন্যায়ের মুখোমুখি হওয়া এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের উত্তরাধিকারের প্রতিকার করা। এ ছাড়া, ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয় তা নিশ্চিত করা।’

গুরুত্বপূর্ণ এই জাতীয় জবাবদিহিতা ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস প্রস্তুত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ফলকার টুক।

আরও পড়ুন

প্রবাসীদের ভোটের জন্য আসছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ

প্রবাসীদের ভোটের জন্য আসছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিবন্ধনের জন্য ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামের অ্যাপ তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।

১৬ ঘণ্টা আগে

ঢাকায় ভিসা আবেদন কেন্দ্র চালু করেছে ফ্রান্স

ঢাকায় ভিসা আবেদন কেন্দ্র চালু করেছে ফ্রান্স

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অত্যাধুনিক ভিসা আবেদন কেন্দ্র চালু করেছে ফ্রান্স। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ভিসা প্রার্থী বাংলাদেশি আবেদনকারীদের উন্নত সেবা প্রদানের জন্য আবেদন কেন্দ্রটি চালু করা হয়।

১৯ ঘণ্টা আগে

প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন শুরু হতে পারে অক্টোবরে

প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন শুরু হতে পারে অক্টোবরে

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভোট দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আছে বলে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

১৯ ঘণ্টা আগে

লি‌বিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন আরও ১৭৬ বাংলাদে‌শি

লি‌বিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন আরও ১৭৬ বাংলাদে‌শি

অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে লিবিয়ায় ধরা পড়া ১৭৬ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।

১৯ ঘণ্টা আগে