logo
মতামত

বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবনমন: বৈশ্বিক মঞ্চে মর্যাদাহানি

শাহাবুদ্দিন শুভ
শাহাবুদ্দিন শুভ১০ দিন আগে
Copied!
বাংলাদেশি পাসপোর্টের অবনমন: বৈশ্বিক মঞ্চে মর্যাদাহানি
ছবি: সংগৃহীত

কিছু খবর আছে, যা দেখলে বা শুনলে অজান্তেই মন খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন সেই খবর আপনার নিজের পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। যখন দেখেন, আপনার দেশের মর্যাদা বিশ্ব পরিমণ্ডলে ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রবাসী হিসেবে এমন সংবাদ শুনলে মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।

আমি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেই হয়—বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বেশ হতাশাজনক।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর যেসব দেশে আমি গিয়েছি, তার মধ্যে ভারতের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাই সবচেয়ে খারাপ লেগেছে। মনে হয়েছে, তারা যেন বাংলাদেশের মানুষকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না।

বিদেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের প্রতি বৈষম্য

২০১৪ সালের দিকে থাইল্যান্ড ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতা আজও মনে পড়ে। রাতের ফ্লাইটে ব্যাংককে পৌঁছে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, যাত্রীদের দেশ অনুযায়ী আলাদা লাইনে ভাগ করা হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের যাত্রীদের দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়া হলেও বাংলাদেশি যাত্রীদের আলাদা করে বসিয়ে রাখা হলো।

লেখক
লেখক

অপেক্ষার একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আমি ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললাম, ‘আপনাদের দেশে ঢুকতে না দিলে পরের বিমানে তুলে দিন, আমি ফিরতে রাজি।’ পরে এক কর্মকর্তা এসে আমার পাসপোর্ট দেখে পেশা জানতে চান, তারপর আমাকে ছাড়পত্র দেন। কিন্তু অন্য অনেক বাংলাদেশি তখনো সেখানে বসে ছিলেন।

এই অভিজ্ঞতা কেবল থাইল্যান্ডে নয়; ইউরোপের বহু দেশেও একই রকম। বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখামাত্রই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের আচরণে বোঝা যায়, পাসপোর্টের রং নয়—এর মানই আমাদের দেশের সম্মানকে প্রকাশ করে।

হেনলি পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশের অবনমন

সম্প্রতি প্রকাশিত হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫–এর তথ্য আরও হতাশাজনক। ২০২৫ সালের সর্বশেষ (৭ অক্টোবর) প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ১০০তম স্থানে নেমে গেছে। ২০২৪ সালের শুরুতে এই অবস্থান ছিল ৯৭তম। অর্থাৎ, আমরা আরও তিন ধাপ পিছিয়েছি।

এই সূচকে বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে আছে আন্তর্জাতিকভাবে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত উত্তর কোরিয়া। এর ফলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা এখন বিশ্বের ২২৭টি গন্তব্যের মধ্যে মাত্র ৩৮টি দেশে ভিসামুক্ত বা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা পাচ্ছেন—যেখানে গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪২।

তুলনামূলকভাবে, গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমার এখনো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে (৯৬তম স্থান)। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৮৫তম, ভুটানের ৯২তম এবং থাইল্যান্ডের ৬৬তম। দুই দশক আগে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম, যা আজ নাটকীয়ভাবে নিচে নেমে গেছে।

পাসপোর্টের মানের পতন ও নাগরিক ভোগান্তি

এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট নয়; বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় বাংলাদেশি পাসপোর্টের মান কোথায় দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু তাঁর সন্তানকে নিয়ে পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে গিয়েছিলেন স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে। অন্য দেশের যাত্রীরা আধা ঘণ্টার মধ্যে ইমিগ্রেশন পার হলেও তাদের তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে যখন যাত্রীদের সকল তথ্য স্ক্রিনে দৃশ্যমান, তখনো বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখলেই কর্মকর্তারা অতিরিক্ত প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন।

সমাধান কী হতে পারে

পাসপোর্টের মান কেবল একটি বইয়ের কভার নয়; এটি একটি দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদার প্রতিফলন। সরকারের উচিত বৈদেশিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক অবস্থান এবং নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়ায় এমন পরিবর্তন আনা, যাতে বিশ্ব বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।

আজ সময় এসেছে ভেবে দেখার—আমরা কেন ক্রমাগত নিচের দিকে নামছি এবং কীভাবে আবার ওপরে উঠতে পারি।

কারণ, পাসপোর্টের মান শুধু কাগজের মান নয়, এটি আমাদের জাতিসত্তার মর্যাদা বহন করে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

*লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]

আরও দেখুন

‘আমরা ম্যানেজ করে নেব’

‘আমরা ম্যানেজ করে নেব’

দুপুরে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। দেখি আরেকটা ট্রাক থেকে ওয়াশিং মেশিন নামাচ্ছে। বিরাট গাবদা সাইজ। দুই/তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠাতে হবে। বেচারার গার্লফ্রেন্ড নেই পাশে। এবার দেখি ছেলেলা আমার দিকে তাকায়, ‘হাই’ দেয়।

২০ ঘণ্টা আগে

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

ষাটের দশক শুধু জেইনের জীবন নয়, বদলে দিল এক পুরো প্রজন্মকে। মানুষ শিখল প্রশ্ন করতে, প্রতিবাদ করতে, আর ভালোবাসতে। সত্যিই, এক নতুন সময়ের জন্ম হয়েছিল।

২ দিন আগে

ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ওমান রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে ওমানে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণাতেও অবদান রাখতে পারে।

২ দিন আগে

রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার

রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য রাজস্ব খাত ও আর্থিক খাতের সংস্কারকে সংহতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এটি শুধুমাত্র উন্নয়নের জন্য নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪ দিন আগে