logo
মতামত

স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং নিয়তির এক অনন্য যাত্রা

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা৯ দিন আগে
Copied!
স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং নিয়তির এক অনন্য যাত্রা
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ইংল্যান্ডের শান্ত ছোট্ট শহর স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন নদীর তীরে এক সাধারণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল একটি শিশুর। তার নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। জন্মের মুহূর্তে কেউ ভাবতেও পারেননি যে এই ছেলেটিই একদিন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নাট্যকারদের একজন হয়ে উঠবে। তার জীবন শুধুই সাফল্যের গল্প নয়; স্বপ্ন দেখা, হার না মানা এবং কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার গল্প।

শৈশবের শুরু

শেক্সপিয়ারের বাবা ছিলেন গ্লাভস নির্মাতা, মা ছিলেন কৃষক পরিবারের পরিশ্রমী সন্তান। পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত। ঘরে বইয়ের অভাব থাকলেও গল্পের কোনো অভাব ছিল না। ছোট উইলিয়াম বাজারের মানুষের কথাবার্তা, প্রকৃতির রূপ, চার্চের উপদেশ—এসব থেকেই ভাষার সৌন্দর্য শিখতে শুরু করে। উইলিয়াম তখনো জানত না, এই ভাষাই তাকে অমর করে তুলবে।

কৈশোরে প্রথম ধাক্কা

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ল। বাবার ব্যবসা ভেঙে গেল, সংসারে নেমে এল অনটন। বাধ্য হয়ে উইলিয়ামকে স্কুল ছাড়তে হয়। অনেকে তখন ধরে নিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কিন্তু এই দুঃসময়েই তার ভেতর জন্ম নেয় এক দৃঢ় স্বপ্ন। উইলিয়াম জীবনে হার মানতে রাজি হয়নি।

তরুণ উইলিয়ামের পথচলা

কৈশোর থেকেই নাটক ও অভিনয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয় তার। কিন্তু ছোট শহর বড় স্বপ্নকে জায়গা দিতে পারে না। অবশেষে উইলিয়াম নিজের জন্মশহর ছাড়িয়ে একসময় চলে আসে লন্ডনে। কীভাবে পৌঁছেছিল—তা আজও রহস্য। কেউ বলে উইলিয়াম হেঁটে এসেছে, কেউ বলে কোনো ভ্রমণকারীর সঙ্গে কাজ করে এসেছে।

লন্ডন তখন ছিল প্রাণচঞ্চল—নাট্যশালা, সংগীত, কবি, রাজনীতি, শিল্প—সব মিলিয়ে এক মাথা ঘোরানো পৃথিবী। সেখানে প্রথমে উইলিয়াম খুব সাধারণ কাজ করত—কেউ বলে ঘোড়ার দেখাশোনা, কেউ বলে মঞ্চ সাজানোর কাজ। কিন্তু তার মন লিখতে চাইত, আর চোখ ছিল ভবিষ্যতের দিকে।

প্রথম নাটক খ্যাতির সূচনা

মঞ্চের আড়ালে কাজ করতে করতে উইলিয়াম শিখতে থাকে মানুষের হাসি-কান্না, আবেগ, ক্ষমতার খেলা, বিশ্বাসঘাতকতা, মানবস্বভাবের অন্ধকার ও আলোর দিক। এই অভিজ্ঞতাগুলোই ধীরে ধীরে তার লেখায় রূপ নিতে থাকে।

অল্প সময়েই সাহিত্যজগৎ লক্ষ্য করল—তরুণটি আলাদা। তার নাটক মঞ্চে উঠতেই দর্শক স্তব্ধ হয়ে যেত। তার শব্দ যেন নেচে উঠত, সংলাপ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ত, আর মঞ্চে উঠে আসত মানুষের জীবনের নির্মম সত্য।

সাফল্যের তুঙ্গে শেক্সপিয়ার

অল্প সময়ের মধ্যেই লন্ডনে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকে কালজয়ী নাটক—‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’, ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘কিং লিয়ার’। তার প্রতিটি নাটক মানুষের হৃদয় ভেঙে আবার গড়ে তোলে। যিনি একসময় দারিদ্র্যের কারণে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনিই ইংরেজি সাহিত্যকে নিয়ে গেলেন অভূতপূর্ব উচ্চতায়।

জীবনের শেষ অধ্যায়

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লন্ডন ধেকে ফিরে আসেন নিজের জন্মশহর স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভনে। সেখানে কিছু শান্ত সময় কাটান, লেখালেখি চালিয়ে যান। মৃত্যুর শত শত বছর পরও তার সাহিত্য আজও পাঠ্য, অভিনীত ও গবেষণার অন্যতম বিষয়।

শেক্সপিয়ারের জীবন শেখায়—স্বপ্ন সত্য হলে জন্ম, দারিদ্র্য বা বাধা কোনো কিছুই তাকে থামাতে পারে না। পরিশ্রম, ধৈর্য ও নিজের প্রতিভার প্রতি বিশ্বাস মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে। তিনি প্রমাণ করেছেন—শব্দের শক্তি পাহাড়ের চেয়েও দৃঢ়, আর স্বপ্নের শক্তি নিয়তির চেয়েও বড়।

আমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

জুন ২০২৩—এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম বিলেতে। মাত্র সাড়ে তিন দিনের ছোট্ট সফরে বেশ কিছু ছোট-বড় শহর ঘোরা এবং কিছু ঘটনা মনের মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আজ প্রযুক্তির যুগে ঘরে বসেই অনলাইনে বিশ্বভ্রমণ করা সম্ভব। তবুও বাস্তব চোখে দেখা অনুভূতি কখনোই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাওয়া যায় না।

ভ্রমণে ঘটতে থাকে ছোটখাটো নানা ঘটনা। যেমন—হঠাৎ রাস্তায় বড় ট্রাফিক জ্যাম। জানা গেল, দুটি গাড়ির ধাক্কাধাক্কিতে সবকিছু থেমে গেছে। আবার দেখা গেল—একটি পরিবার অনলাইনে চেক-ইন মিস করায় বিমানে উঠতে পারেনি, বিমানবন্দরে বসেই কান্না। এ ধরনের ঘটনা প্রতিক্ষণের সঙ্গী। তবুও সব বাধা পেরিয়ে ভ্রমণ শেষে আমরা ফিরে যাই—পুরোনো স্মৃতি ভুলে আবার নতুন ভ্রমণের স্বপ্ন দেখি। এটাই জীবন—চলছে নিজের গতিতে, চলবে যতদিন আমরা থাকব।

বহু বছর পর আবার লন্ডনে থিয়েটার দেখলাম—টানা তিন ঘণ্টা। মাঝখানে বিরতি—যেখানে সবাই খাবার, পানীয় ও আড্ডায় মেতে ওঠে। ঘণ্টা বাজলেই আবার পুরো মনোযোগ মঞ্চে। ছোটবেলায় যাত্রাপালা দেখার কথা মনে পড়ল—পার্থক্য শুধু পরিবেশের। বিলেতের প্রাসাদসুলভ থিয়েটার আর আমাদের গ্রাম্য মেলা—তবুও শিল্পের অনুভূতি একই।

সঙ্গীদের দাবি—সারা দিনের ক্লান্তিতে নাকি আমি পুরো শোর সময় নাক ডেকে ঘুমিয়েছিলাম!

স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন ভ্রমণ

পরদিন রওনা দিলাম স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন এবং ওয়ারউইক ক্যাসেলের উদ্দেশে। লন্ডন ছাড়তেই দুই ঘণ্টা, তারপর মোটরওয়েতে জ্যাম। শেষে ছোট গ্রামের রাস্তা ধরে চলতে চলতে বিলেতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছালাম শেক্সপিয়ারের শহরে।

হৃদয়ে ভেসে উঠল প্রায় ৪৫৯ বছর আগের সেই প্রতিভাবান মানুষের স্মৃতি—যার জন্ম ২৩ এপ্রিল ১৫৬৪, মৃত্যু ২৩ এপ্রিল ১৬১৬। ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী নাট্যকার হিসেবে আজও তাকে শ্রদ্ধা করা হয়।

প্রতিদিন হাজারো মানুষ বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন তার বাড়ি দেখতে। বাড়ি থেকে মাত্র আট মাইল দূরেই ওয়ারউইক ক্যাসেল—হাজার বছরের পুরোনো দুর্গ। ফেরার পথে সেখানেও কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অক্সফোর্ড হয়ে লন্ডনে ফেরত এলাম।

বাঙালির সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভাবনা

পরদিন ছিল নতুন প্রজন্মের বিয়ে—আমার ছোট ভাই শাহীনের ছেলের বিয়ে ইস্ট লন্ডনে। তিন শতাধিক অতিথি। তবে বাঙালির স্বভাবগত বিষয়—কার্ডে বারোটা লেখা, কিন্তু দেড়টার আগে কেউ এলেন না! সবাই তবুও স্বাভাবিক।

একটি প্রশ্ন আমাকে ভাবায়—বিশ্বের নানা দেশে থাকা বাঙালিরা অর্থনৈতিকভাবে সফল হলেও সামাজিকভাবে এখনো পুরোপুরি একীভূত হতে পারে না। এর দায় কি শুধু তাদের, নাকি রাষ্ট্রেরও ভূমিকা রয়েছে?

ভাবুন—দশ বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বাস করছে। তারা বিদেশি, নানা সাহায্য পাচ্ছে। তবুও তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, বাংলাদেশের নাগরিকও নয়। ভবিষ্যতে যদি বিশ্বসাহায্য বন্ধ হয়ে যায়—তবে তারা কি শুধু কাগজে-কলমে ‘শরণার্থী’ হয়েই থাকবে? নাকি কখনো সত্যিই বাংলাদেশি হয়ে উঠতে পারবে? দায় কার—শুধু রোহিঙ্গাদের, নাকি আমাদেরও?

শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটে বলা: “To be, or not to be, that is the question.” একই নাটকে মাকে উদ্দেশ করে বলা—দুর্বলতা, তোমার নাম নারী। শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও শেক্সপিয়ারের সাহিত্য আজও আধুনিক, প্রাণবন্ত এবং মানুষের চেতনায় গভীরভাবে প্রোথিত।

আমার মনে তাই একটি প্রশ্নই ঘোরে—বিশ্বের নানা বর্ণ, ভাষা ও ধর্মের মানুষের মধ্যে সত্যিকারের একীভূত হওয়া কি কখনো সম্ভব?

To be, or not to be—that is indeed the question.

*লেখক গবেষক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। ইমেইল: [email protected]

আরও দেখুন

কবিতা: বিজয়ের শব্দতরঙ্গ

কবিতা: বিজয়ের শব্দতরঙ্গ

আমি দেখি এক তরুণের হাত/ পতাকা ছুঁয়ে থমকে যায়/ যেন এক মুহূর্তে/ ইতিহাস তার বুকে ঢুকে পড়ে/ ধুকধুক ধুকধুক করে।

৩ দিন আগে

কবিতা: আমার দেশ

কবিতা: আমার দেশ

আমার আজও মনে পড়ে/ আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় নীল অপরাজিতার কথা/ মনে পড়ে কোকিলের গেয়ে চলা উচ্চাঙ্গ সংগীতের কথা/ মনে পড়ে বানভাসি মানুষের অজস্র দুঃখের কথা,

৩ দিন আগে

অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্রসৈকতে বন্দুকধারীর হামলা, শান্তিপূর্ণ দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা

অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্রসৈকতে বন্দুকধারীর হামলা, শান্তিপূর্ণ দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা

একটি সভ্য দেশে এ ধরনের বর্বরতা কখনোই কাম্য নয় এবং কখনো এটা আশা করিনি। অস্ট্রেলিয়া একটি শান্তিপূর্ণ দেশ; এখানে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আশা করা যায় না। ধর্মীয় বিদ্বেষ ধেকে এ ধরনের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা শুধু ইহুদির জন্য নয়, আমাদের সবার জন্যই উদ্বেগজনক।

৩ দিন আগে

মরুর বুকে অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট

মরুর বুকে অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট

বাংলাদেশেরও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদেশের মাটিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে, যা অনেকেরই অজানা। প্রতিষ্ঠানটির নাম বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট। এটি ইংরেজি মাধ্যম অ্যাডেক্সসেল কারিকুলামের অধীনে পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ওমানের রাজধানী মাস্কাটের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই স্কুল।

৫ দিন আগে