logo
মতামত

ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইজাজ আহসান২ দিন আগে
Copied!
ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ওমান বাংলাদেশ বন্ধুত্ব প্রায় পাঁচ দশকের। ওমানের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা একই সময়ে। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশ ওমানের সম্পর্কে কোনো বাধা আসেনি। ওমানের পররাষ্ট্র নীতিও তাই, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ বিভিন্ন বিরোধে জড়ালেও দেশটির এই নীতির কারণে ওমান কারও সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়ায়নি। ওমানের অব্যাহত উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনে আছে নেতৃত্বের সততা, নিষ্ঠা আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। ওমানের এই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও বহু দিনের। কিন্তু সেই অর্থে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ততটা জোরদার করা যায়নি, যতটা করা যেতে পারত। ২০২৩ সালে ওমান বাংলাদেশে রপ্তানি করে ৮২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য। এর বিপরীতে ওমানে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪ মিলিয়ন ডলার।

ওমান থেকে বাংলাদেশ মূলত রাসায়নিক পণ্য যেমন—প্রপাইলিন পলিমার, জিপসাম, ইথাইলিন পলিমার আমদানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ওমানে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে ইলেকট্রিক ব্যাটারি, খাদ্যদ্রব্য আর তৈরি পোশাক। এ ছাড়া, ওমানে বাংলাদেশের প্রাণ কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যায়।

ওমানে বাংলাদেশি কিছু উদ্যোক্তাদের ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান সাফল্যজনকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তার মধ্যে গালফ এক্সচেঞ্জ কোম্পানি সবার কাছে বেশ পরিচিত। এ ছাড়াও, রয়েছে বেশ কিছু ছোটখাটো দোকানপাট, টেইলারিং লন্ড্রি, খাবার হোটেল ইত্যাদি।

সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, ৭ থেকে ৮ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ওমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত আছেন। তাদের অধিকাংশই অদক্ষ কর্মী।

পৃথিবীতে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়ছে আর অদক্ষ কর্মীর চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমছে। ওমানসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মী ভিসা বন্ধ। এরপরও বিপুলসংখ্যক অদক্ষ বাংলাদেশি কর্মী এসব দেশে বিভিন্নভাবে এসে পড়েছেন। তাদের জন্য নেই কোনো কর্মসংস্থান। আবার কারও কারও স্থায়ীভাবে কাজ নেই। কিছুদিন কাজ থাকে তো আবার কাজ থাকে না। এই সমস্ত কর্মীরা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপুলভাবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। কয়েক দশক ধরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দেশে যেহেতু ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি আর হচ্ছেও না, তাই দেশান্তরী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ তাদের সামনে খোলা ছিল না।

ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউ, দক্ষিণ আফ্রিকার গহিন জঙ্গল, এমনকি লুকিয়ে বিমানের চাকায় করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার নির্মম রোমমহর্ষক কাহিনি আর নাই বা বললাম। কিন্তু বিদেশে কাজের সুযোগ ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে, তাই বিদেশি কর্মীর চাহিদা কমে আসছে ধীরে ধীরে।

অন্যদিকে দক্ষ কর্মীর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু আমাদের দক্ষ কর্মী সৃষ্টির তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। নিকট ভবিষ্যতে একটা পর্যায় হয়তো দেখা যাবে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছে। তখন বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে পণ্য রপ্তানির ওপর। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল, যদিও বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনাময় পণ্য রয়েছে।

এসব বিস্তারিত আলোচনার বিষয়। সেই কথায় আসে ওমানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বহুমুখী করার। সেইসঙ্গে বাংলাদেশি পণ্যের স্থায়ী বাজার গড়ে তোলা। ওমানে বর্তমানে ভারতীয় পণ্য আর ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশও চেষ্টা করলে তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত করতে পারে। কিন্তু এর জন্য যা দরকার তা হলো, পরিকল্পনা, বাজার গবেষণা আর উদ্যোগ।

বাংলাদেশে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বণিক সংগঠন। যেমন বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ—এগুলো থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পণ্য বিদেশের বাজারে স্থান করে নিতে পারছে না।

দ্বিতীয়ত, ওমানে বাংলাদেশের দূতাবাস আছে, যারা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশে বসে অন্য সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা সম্ভব দূতাবাসের। বাংলাদেশের পণ্যের পরিচিতি ও প্রসারের জন্য দূতাবাসের অধীন একটি স্থায়ী ট্রেড সেন্টার স্থাপন করার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। তাহলে এখানকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে সরাসরি তথ্য পাবে।

ওমান অন্যতম ধনী দেশ হওয়ায় এখানে বিলাস দ্রব্যের চাহিদা যথেষ্ট। বাংলাদেশের আসবাবপত্র, সিরামিকের তৈজসপত্র, হস্তশিল্পজাত পণ্যের বিরাট বাজার সৃষ্টির সুযোগ আছে। হাতের কারুকাজ করা ওমানিদের ঐতিহ্যবাহী টুপি বাংলাদেশে তৈরি হয়। এ রকম আরও অনেক পণ্য ওমানের বাজারে স্থায়ী আসন পেতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে নিবিড় বাজার গবেষণার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ বর্তমানে রপ্তানি ক্ষেত্রে বাজার ও পণ্য বহুমুখী করণের কথা বলছে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক বাস্তবতা এটাই যে, একক পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা।

ওমানসহ তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো এই লক্ষ্যে তাদের পর্যটন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এখন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন আকর্ষণ। সৌদি আরব, ওমান ও কাতার পর্যটন শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ করছে। তার ফলও তারা পাচ্ছে। অথচ দেশগুলো মূলত মরুভূমি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে দুটি জিনিসের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এক বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, আর ধীরে ধীরে সস্তা পণ্য উৎপাদন থেকে ভারী শিল্প ও মূল্যবান পণ্য উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। যেমন–দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ান একসময় সস্তা পণ্য উৎপাদন করত। বর্তমানে তারা উন্নত প্রযুক্তির পণ্য তৈরি করছে। এমনকি তাইওয়ান ও কোরিয়ার উৎপাদিত সেমি কন্ডাক্টর ও মাইক্রো চিপের ওপর উন্নত বিশ্বও অনেকাংশে নির্ভরশীল।

এক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর। কালক্রমে সেই পাটজাত পণ্যের বাজার খুবই সীমিত। বাংলাদেশে আদমজী জুট মিলসহ বড় বড় পাটের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা সময় আসবে যখন সস্তা কর্মী আর বিদেশে যাবে না। আর দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে তার দরকারও হবে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এই সমস্ত দেশে আমাদের পণ্যের বাজার গড়ে তুলতে হবে।

এখন যেভাবে বাজার খোঁজা হয় তা মূলত এখানে প্রবাসীদের দিকে লক্ষ্য রেখে। প্রবাসী চলে গেলে বা তাদের সংখ্যা কমে গেলে এই বাজার স্থায়ী হবে না। তাই স্থায়ী বাজার রাখতে হলে ওমানিদের চাহিদার দিকেও নজর দিতে হবে।

ওমানে শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সাল থেকে অদ্যাবধি শিক্ষা ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। এখানে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকমন্ডলি ওমান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয়েছে।

ওমান রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে ওমানে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণাতেও অবদান রাখতে পারে। নতুন বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নতির শিখরে উঠতে চায় তবে ওমানসহ বিভিন্ন দেশে থাকা সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুতাবাসগুলোকে এসব কাজে সক্রিয় করে তুলতে হবে। পাশাপাশি নিবিড় বাজার গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। আশা করি এই প্রচেষ্ঠা নতুন বাংলাদেশ দেশের আপামর জনগণ ও প্রবাসীদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেবে।

তথ্য সুত্র: Observatory of Economic Complexity (OEC)

*লেখক বিভাগীয় প্রধান (ব্যবসায় শিক্ষা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান

আরও দেখুন

‘আমরা ম্যানেজ করে নেব’

‘আমরা ম্যানেজ করে নেব’

দুপুরে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। দেখি আরেকটা ট্রাক থেকে ওয়াশিং মেশিন নামাচ্ছে। বিরাট গাবদা সাইজ। দুই/তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠাতে হবে। বেচারার গার্লফ্রেন্ড নেই পাশে। এবার দেখি ছেলেলা আমার দিকে তাকায়, ‘হাই’ দেয়।

২০ ঘণ্টা আগে

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

স্বাধীনতার এক নির্মম পরিহাস

ষাটের দশক শুধু জেইনের জীবন নয়, বদলে দিল এক পুরো প্রজন্মকে। মানুষ শিখল প্রশ্ন করতে, প্রতিবাদ করতে, আর ভালোবাসতে। সত্যিই, এক নতুন সময়ের জন্ম হয়েছিল।

২ দিন আগে

ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ওমান–বাংলাদেশ সৌহার্দ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ওমান রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে ওমানে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হবে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণাতেও অবদান রাখতে পারে।

২ দিন আগে

রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার

রাজস্ব আহরণ ও আর্থিক সংস্কার: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করার অপরিহার্য হাতিয়ার

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য রাজস্ব খাত ও আর্থিক খাতের সংস্কারকে সংহতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এটি শুধুমাত্র উন্নয়নের জন্য নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪ দিন আগে