আব্দুল হালিম মিয়া, টরন্টো, কানাডা
বাংলাদেশের সংস্কার প্রস্তাবসূমহের কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের উপায় নিয়ে টরন্টোয় কানাডিয়ান সেন্টার ফর বাংলাদেশ ষ্টাডিজের (সিসিবিএস) উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট (শনিবার) টরন্টোর এগলিনটন স্কোয়ার পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে স্থানীয় সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান প্রফেসর ড. আহমেদ শফিকুল হক।
স্বাগত বক্তব্য দেন সিসিবিএসের পরিচালক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম মিয়া।
সেমিনারে ঢাকা থেকে ভার্চুয়্যালি যুক্ত হয়ে মুল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
অতিথি বক্তা ছিলেন কানাডার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির সোস্যাল সায়েন্সের প্রফেসর ড. সাদিকুল ইসলাম, কানাডার লেইকহেড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মাহফুজুল হক, সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কানাডার এলগোমা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. নুসরাত আজিজ, ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই দারুস সালামের প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ এবং লিডারশিপ ষ্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ।
হোস্ট প্যানেলে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাফি ভুইয়া, ব্যারিষ্টার কামরুল হাফিজ, মিডিয়া ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈকত রুশদী, সাবেক ছাত্রনেতা ও পিএইচডি অধ্যায়নরত সাহাবুদ্দিন লাল্টু।
সবিতা সোমানির সঞ্চালনায় সেমিনারটি সফলভাবে আয়োজনে সহযোগিতা করেন নাহিদ শরীফ, সামসুল ইসলাম ফায়সাল, নয়ন হাফিজ, ইউসুফ সেখ, তৌহিদ নুর ও গাজী সজল।
অনুষ্ঠানটি সরাসরি ধারণ করে প্রচার করে এনআরবি টেলিভিশন, যাত্রা টেলিভিশন ও প্রবাসী টেলিভিশন।
বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় অনলাইন জুমের মাধ্যমে কিনোট স্পিকার ড. হোসেন জিল্লুর রহমান তার বক্তৃতার শুরুতে এরকম একটি গুরুত্বপুর্ণ আয়োজনের জন্যে সিসিবিএসকে ধন্যবাদ জানান।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব আলোচনার আগে, আমাদের জানা দরকার, এই যে বহু মানুষের আত্মাহুতির মাধ্যমে চব্বিশের জুলাই– আগস্টে যে বিশাল রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন হলো, সেখানে সংস্কারের চাহিদাগুলো কী ছিল? চাহিদাগুলো আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার। বর্তমান সময়ে সংস্কার প্রস্তাব আলোচনার যে পর্যায়ে আছে সেখানে পরিবর্তনের চাহিদার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে তা আমাদের বোঝা দরকার।
‘আগস্ট ২০২৪–এ যে সর্বজনীন একটা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল, তখনকার চাহিদা আসলে কী ছিল? চাহিদার ৩টি দিক ছিল—প্রথম চাহিদাটা ছিল, বিগত ১৫ বছরে যে কর্তৃত্ববাদী শাসন ছিল সেটার অবসান। কর্তৃত্ববাদী শাসন যখন আমরা বলি, তার স্তম্ভগুলো কী? কিসের ওপরে এগুলো তৈরি হয়েছে? ৪টি স্তম্ভের ওপরে এই ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছিল বলে আমি মনে করি।
‘প্রথম স্তম্ভটা হলো জবাদদিহিতার উর্ধে একটা প্রধান নির্বাহী। অতি ক্ষমতাশালী একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি ছিলেন সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধে, এই প্রধান নির্বাহীর একটা অবসান আমাদের সেই চাহিদার একটা ছিল। এটা ৪টি স্তম্ভের খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা স্তম্ভ।
‘দ্বিতীয় স্তম্ভ ছিল সেই জবাবদিহিতার উর্ধে প্রধান নির্বাহীর মতো আবার ছোট ছোট আঞ্চলিক যেটাকে আমি বলব এমপি–রাজ। প্রতিটা সংসদীয় আসনে এমপির অবস্থান ছিল অনেকটা প্রধান নির্বাহীর মতো, জবাবদিহিতার উর্ধ্বে যারা সবকিছুই কন্ট্রোল করেছে। সেটা স্হানীয় সরকার হোক, পুলিশ হোক, সবকিছুতে। কাজেই এই যে এমপি–রাজ, এই বিষয়টার একটা অবসান কিন্তু মানুষ চেয়েছে। কারণ কর্তৃত্ববাদী শাসনের এইটাও একটা বড় ধরনের স্তম্ভ।
‘তৃতীয় স্তম্ভ হলো আমাদের আমলাতন্ত্র। আমলা ও পুলিশ প্রশাসনের অতিমাত্রায় পার্টিজান ব্যবহার। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে দেওয়া, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হয়তো এসপির সঙ্গে কথা বলছেন, এই যে চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে একটা যে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসিপ্লিন সেটা একেবারেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে কারও ইচ্ছের ওপর সবকিছু চলে। এই চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা, প্রাতিষ্ঠানিক নর্মসগুলো ফিরিয়ে এনে প্রতিস্থাপন করা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান যদি আমরা দেখতে চাই, এইটাও একটা গুরুত্বপুর্ণ স্তম্ভ।
‘চতুর্থ স্তম্ভ যেটা ছিল, আরবিটারিরি ডিটেনশন, মানে গুম–খুন ইত্যাদি। একটা ক্লাইমেট অব ফেয়ার তৈরি করা, যেটা একটা বড় ধরনের মানুষের মনের মধ্য ভয় ধরিয়ে দিয়ে দাবিয়ে রাখা। এগুলোই ছিল আমাদের ২০২৪–এ যে পরিবর্তন আমরা চাইছি তার অন্যতম একটা চাহিদা।
‘দ্বিতীয় যে চাহিদা ছিল, সেটাও খুবই গুরুত্বপুর্ণ, গত ১৫ বছর মানুষ সেই অর্থে তার নিজের প্রতিনিধিদের বেছে নিতে পারেনি। এক ধরনের স্বচ্ছন্দের ভিত্তিতে, একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচনী একটা আবহের মাধ্যমে। তাই অবশ্যই একটা ডেমোক্রেটিক ট্রানজিসন মানে একটা নির্বাচনের বিষয়টাও অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং সেটার জন্যে নির্বাচনী পরিবেশটাও নিশ্চিত করা, এটাও একটা গুরুত্বপুর্ণ চাহিদা।
‘তৃতীয় যে চাহিদা আমি উল্লেখ করব সংস্কৃতির একটা বিষয়, যে আমাদের একটা জাতীয় ঐক্যের একটা মুড এবং একটা ইনক্লুসিভ সোস্যাল এনভায়রনমেন্ট দরকার। মানে আমাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমুলক পরিবেশ না হলে একটা সামাজিক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা খুব কঠিন। কাজেই সংস্কার চাহিদা বোঝাটা খুব জরুরি। বিভিন্ন বিষয়ে ১১টা সেক্টরাল কমিশন হয়েছে আপনারা জানেন। কিন্তু তার মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের ফোকাসটা একটু বেশি পড়েছে একটা জায়গার ওপর। সেটা হলো সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর। এর ওপরই তাদের সবচেয়ে বড় নজর আছে, কিন্তু সংস্কারের অবশ্যই আরও একটা বিষয় ছিল, সেটা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির যে ভয়ানক ধ্বস নেমেছিল, সেটাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এখন আমি যদি দেখি কীভাবে সংস্কার প্রক্রিয়াটা এগিয়েছে, এই যে সামষ্টিক অর্থনীতির ধ্বস এটার জন্যে কিন্তু সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন হয় না। এটা প্রশাসনিক পদ্ধতিতেই এখানে পরিবর্তন আনা সম্ভব এবং সেখানে যথেষ্ট এক ধরনের শৃঙ্খলা অনেকটা আনা হয়েছে। কিন্তু আমি যত দূর দেখছি এ পর্যন্ত এই যে ঐকমত্য কমিশনের কথা বলি এবং সেখানে দেখুন মানুষের সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে এবং সেটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ—অতি ক্ষমতায়িত প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টা খুব গুরুত্ব পেয়েছে। পার্লামেন্টের ধরন কী হবে, নির্বাচনের পদ্ধতি খুব গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে মানুষের চাহিদার অন্য বিষয় যেগুলো ছিল, স্থানীয় সরকারের সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, নারী বিষয়ক সংস্কার, এইগুলো কিন্তু সেরকম নজরের মধ্যে নেই। এগুলো এক অর্থে কমিশনের রিপোর্ট জমা হয়েছে, সেখানে প্রশাসনিকভাবে কিছু কিছু এগোচ্ছে বটে, কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম ফোকাস হচ্ছে সুনির্দিষ্টএকটা জায়গার মধ্যে সেটা হচ্ছে সাংবিধানিক বিষয়গুলো, নির্বাচনী বিষয়গুলো এবং সেই জন্যে আন্য যে বিষয়গুলো যেটা বলছিলাম, কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে অন্য স্তম্ভগুলো ঠিক ওইভাবে সংস্কারের আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি। সেটা একটা সমস্যা হিসেবে আমি দেখছি ভবিষ্যতের জন্যে।
‘আরও একটি বিষয় হচ্ছে, সংস্কারের আলোচনার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ের যে বৈশিষ্ট, এখানে কিন্তু আলোচনাটা মুলত হচ্ছে যে দলগুলো আছে এবং ঐকমত্য কমিশন, তারা হয়তো অরগানাইজড কনসালটেসন করেছে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ায় এক ধরনের এলিটিজম আমরা দেখতে পেয়েছি। এই যে মানুষের সঙ্গে যে আলোচনার জায়গাগুলো, হয়তো তারা বলছে যে আমরা মাঠে গিয়ে কিছু আলোচনা করেছি। কিন্তু সংস্কার আলোচনা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে পুরো বিষয়টা এক ধরনের এলিটিস্ট বিষয়ের দিকে গেছে।
‘এখন আমি যদি শেষ বিষয়টা বলি, আপনাদের যে আগ্রহ আছে, যে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়? বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই আমরা ঐকমত্যের প্রক্রিয়া কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। জুলাই সনদ বললেও আমরা এখনো কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে আছি, সেপ্টেম্বরে ঢুকব, সো ওইখানে কিন্তু অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো এখনো রয়ে গেছে। বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ যদি আমি বলি, আমি কয়েকটা বলছি, আপনারা নিশ্চয়ই আরও অনেকগুলো দেখবেন, আপনাদের তরফ থেকে উঠে আসবে, একটি বিষয় হচ্ছে এখানে চাহিদার বিষয়ে এখনো ঐকমত্যের জায়গাটা সেই অর্থে তৈরি করা হয়নি বা হচ্ছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রাজুয়্যালি আমাদের এক ধরনের কনফ্রন্টেশনাল অ্যাটমসফেয়ার তৈরি হচ্ছে। সো ঐকমত্য কমিশন হয়তো অনেক চেষ্টা করেছে, প্রায় ৫–৬ মাস ধরে কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক খেলোয়াড় যারা আছেন, তাদের সঙ্গে যমুনায় বৈঠক করছে বটে। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনার দুর্বলতা যেটা দেখতে পাচ্ছি, ঐকমত্যের জায়গাটা এখনো সিকিউর করার ব্যপারে রাজনৈতিক সক্ষমতার একটা ঘাটতি দেখছি ঐকমত্য কমিশনের এবং সেই অর্থে অন্তর্বর্তী সরকারেরই।
‘অতএব সেখানে একটা অনিশ্চয়তার জায়গা রয়ে গেছে এবং আমরা আশা করব সেপ্টেম্বরে হলেও তারা হয়তো একটা জায়গায় পৌঁছুতে পারবে। কিন্তু গ্রাজুয়েলি যে বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো, কনফ্রনটেশনের যে বিষয়গুলো, এগুলো এক অর্থে দেখা যাচ্ছে যে, ছাড় দেবার তেমন কোনো মনোভাব নেই। ছাড় দেওয়া ছাড়াও আরও একটি বিষয় হলো, এই যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যেকোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এখানে কিন্তু এক ধরনের রিজিড একটা আলোচনা হচ্ছে। জনগণের বিষয়টা আলোচনা হচ্ছে কি না। ফর্মুলা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু মানুষতো একটা উত্তরণ চায়। উত্তরণটা তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু এখানে ফর্মুলাভিত্তিক রিজিডিটিতে আটকে থাকার সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সো এই যে ঐকমত্য তৈরির যে জায়গাটা, আপনারা যে বাস্তবায়নের কথা বলছেন, বাস্তবায়নের আগে প্রথম বিষয়টি যে ঐকমত্য প্রক্রিয়ার একটা সমাপ্তি টানা, এইটা কিন্তু এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েই যাচ্ছে এবং তা আরও গাঢ় হচ্ছে। তবে আমরা আশা করব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমরা দেখাতে পারব।
‘আর একটা বিষয় দেখছি, সার্বিক আলোচনাটা। এই যে আপনি আমাদের ঐকমত্য তৈরির, সংস্কারের একটা জায়গায় নিয়ে আসা, এখানে কিন্তু যেভাবে জিনিষটা এগিয়েছে, সেটা এক ধরনের ফর্মুলা সলিউশনের দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরির একটা মুড তৈরির কাজটা কিন্তু সমান্তরালভাবে হয়নি। সেই মুডটা না থাকার ফলে কনফ্রন্টেশনের বিষয়টা আরো বেশি এগোচ্ছে।
‘আমি শেষ করব এটা বলে যে, বাস্তবায়নের অন্যতম আরও একটা ঘাটতি হলো অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বৈশিষ্ট তাদের খুব নজরে এসেছে এবং সেটা বলা যায়, একটা দুর্বলতা হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেটা অনেক কিছুতে হচ্ছে। যখন আমরা সরকার শব্দটা ব্যবহার করি, সরকার একটা হচ্ছে তার একটা তো ভিত্তি আছে, তার আইনি একটা ম্যান্ডেট আছে, কিন্তু আপনারা কানাডার কথাও বলছিলেন, কিন্তু ম্যান্ডেট হ্যাস টু বি এক্সারসাইজড, পাওয়ার হ্যাজ টু বি এক্সারসাইজড, রিসপনসিবিলিটি হ্যাজ টু বি এক্সারসাইজড, এই এক্সারসাইজড হওয়ার যে বিষয়টা, সেখানে আমরা কিন্তু বেশ বড় ধরনের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এখানে রিঅ্যাক্টিভ বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। তো সার্বিক বিষয়ে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি যে চাহিদার কথাটা আমি প্রথমেই উচ্চারণ করলাম এই জন্যে যে, আগস্টে যে পরিবর্তনটা হলো, এই চাহিদা কিন্তু মানুষের হৃদয়ের মধ্যে গভীরভাবে বসে আছে। তারা একটা সুস্থ উত্তরণ চায়, অর্থনীতির একটা নুতন ভিত্তি তৈরি হোক সেটা চায়। গণতান্ত্রিকভাবে তারা কর্তৃত্ববাদী শাসনের সব পিলারগুলোর অবসান চায়। কিন্তু সেটা করার জন্যে তারা একটা যে প্রক্রিয়া, বিশেষ করে যে রাজনৈতিক খেলোয়াড়েরা মাঠে আছেন তাদেরকে একত্রিত করার, তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে আসার যে সক্ষমতা। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের খুব গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব। সেই চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু রয়েই গেছে। ওই মুহূর্তেই আমরা রয়ে গেছি। আমরা আশা করব, আমাদের আকাঙ্খার এই সদিচ্ছা, মানুষের হতাশা যতই থাকুক না কেন, মানুষের সেই চাহিদাগুলো কিন্তু এখনো আছে। বাংলাদেশের যে বিশাল সম্ভাবনা আছে, মানুষ, আমাদের যে পরিশ্রমী মানুষ, এতকিছুর মধ্যেও অর্থনীতির চাকাটা কিন্তু চালিয়েই যাচ্ছে সেই সাধারণ মানুষেরা, সেই কৃষকেরা, সেই সাধারণ ভোক্তারা, সেই নারীরা, সেই তরুণেরা সেই চাহিদার প্রতি আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের সেই চাহিদার প্রতি জোরালোভাবে নজর দেওয়াটা দরকার। যাতে করে ২০২৫ সালের বাদবাকি যে সময়টা আছে, সুষ্ঠুভাবে যেন একটা সমাধানের দিকে আমরা এগোতে পারি।’
হোসেন জিল্লুর রহমানের বক্তব্য শেষে হোস্ট প্যানেল থেকে সাবেক ছাত্রনেতা সাহাবুদ্দিন লাল্টু তাঁর কাছে জানতে চান কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসানকল্পে তিনি যে জাতীয় ঐক্যমত আশা করেছেন অথবা গণঅভ্যুত্থানের ষ্টেক হোল্ডারদের মধ্যে একটা ঐক্য চেয়েছেন, তা কীভাবে অর্জন করা সম্ভব?
হোসেন জিল্লুর রহমান এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সেমিনারে উপস্থিত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এর উত্তর পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কানাডার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাদিকুল ইসলাম কয়েক বছর আগের ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করে সংস্কার দরকার। ৫৪ শতাংশ মানুষ রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। দুনিয়ার যেখানেই রেভ্যুলেশন হয়েছে বা রিফর্ম হয়েছে সবজায়গাতেই রাজনীতিবিদরা গুরুত্বপুর্ণ ও প্রধান ভুমিকা পালন করেন। কিন্তু সেই ভুমিকাটা যদি মিসিং হয় তাহলে কী হয়? এর উত্তরে তিনি মানুষের হিউম্যান ন্যাচার বোঝার ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, হিউম্যান ন্যাচার তৈরি হয় নিজ স্বার্থ ও সহানুভুতি থেকে। যে দেশে বিশাল অসমতা রয়েছে সেখানে ঐক্য সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ৩০ লাখ শিশু রাস্তায় বাস করে। লেবার রাইটসে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের মধ্যে একটি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব জায়গায় বিশাল অসমতা। ১০–১২ বছরের শিশুরা স্কুলে না গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। কানাডায় বসে আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের কাজকর্মকে আমরা কানাডায় বসে মনিটর করতে পারি, টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে ভয়েস রেইজ করতে পারি।
সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, জাতীয় ঐকমত্যকে দেখিয়ে বাংলাদেশ এক সময় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। ভিন্নমতেরও একটা সৌন্দর্য রয়েছে। কাজেই ভিন্নমতকেও আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তিনি সেমিনারের স্বাগতিক বক্তা আব্দুল হালিম মিয়ার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ আর্টিকেলে আছে, জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার আর্টিকেল ৩২–এ এবং গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ আর্টিকেল ৩৩–এ রয়েছে।
তিনি বলেন, এই জিনিষগুলো পরিবর্তনের জন্য যে মনোজগত তৈরি হয়েছে তা যদি সত্যিই পরিবর্তন করতে চাই তাহলে শুধু রাজনীতিবিদদের দিয়ে যেমন হবে না, শুধু আমলাদের দিয়ে হবে না, শুধু একাডেমিকদের দিয়ে হবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে এখন চলছে চরম অস্থিরতা, কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। সংস্কারের বিষয়ে যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে সেটুকু নিয়েই আমাদের আপাতত এগিয়ে যেতে হবে। আর বাকিগুলো পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
কানাডার লেইকহেড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে একটা গণবিপ্লব হয়েছে।
তিনি দার্শনিক অ্যারিষ্টটলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কোনো সমাজে যদি বৈষম্য বিরাজ করে তবে সেখানে বিপ্লব হবে। কার্ল ডেভিস বলেছেন, কোনো সমাজে যদি আশা এবং পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য থাকে তাহলে সেখানে বিপ্লব হয়। আর সম্প্রতি কেন রিংগটন নামে একজন তাত্বিক বলেছেন যদি আপেক্ষিক বঞ্চনা বিরাজ করে তবে সেই সমাজে বিপ্লব হবে। একটা বিপ্লব হয় গ্রাম থেকে, আর একটি বিপ্লব হয় শহর থেকে। যদি বিপ্লবটা একেবারে নিচু থেকে হয় তবে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর যদি বিপ্লবটা যদি কেন্দ্র থেকে হয় তবে এই বিপ্লবের ফলাফল হবে এলিট একোমোডেশন। বাংলাদেশে সংস্কার প্রস্তাবসুমহ চার রকমভাবে সফল বাস্তবায়ন হতে পারে: গণভোট, নির্বাহী আদেশে প্রক্লেমশন, সংবিধান সংশোধন, নুতন করে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চালু হলে তা খুবই খারাপ নজির তৈরি হবে বাংলাদেশের জন্যে।
সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, এত দলের ডাকার প্রয়োজন ছিল না। যারা সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা আছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই হয়ে যেত। কারণ এমন সব ব্যক্তিকেও ডাকা হয়েছে যাদের পেছনে ১০ জন লোকও নেই।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন দেশে বারবার সামরিক শাসন আসে? কেন বারবার অভ্যুত্থান হয়? বাংলাদেশে দরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।
তিনি সংস্কার প্রস্তাবসুমহবাস্তবায়নের জন্যে সকল মহলের আন্তরিকতার ওপর গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশ সরকারের শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মাহফুজুল হক শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি শ্রমের মর্যাদা দিতে সকলকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, একজন রিকশাচালককেও তুই তোকারি করা যাবে না।
মাহফুজুল হক সকল দলের মেনিফেস্টোতে সংস্কার প্রস্তবাসমূহ সংযোজনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে এগুলো থাকলে তাদেরকে নির্বাচন পরবর্তী চাপ দেওয়া সম্ভব হবে যদি বাস্তবায়নে তারা গড়িমসি করেন।
কানাডার আলগোমা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নুসরাত আজিজ বলেন, বর্তমান প্রজন্ম এআই প্রজন্ম। এ প্রজন্মের জন্য অনেক কিছু নুতন করে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ প্রজন্মটাই নতুন প্রজন্ম। তাদের থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের অবশ্যই ইনক্লুসিভ এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রিফর্মের যেগুলো প্রস্তাব সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
নুসরাত আজিজ কানাডা আমেরিকার পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা মিনিষ্ট্রির টাকা খরচের জবাবদিহিতা আদায় করে নেন।
তিনি বাংলাদেশের পার্লামেন্টের সংসদীয় কমিটিগুলোতে বিরোধী দলীয় সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিটিগুলোতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ লোকদের নিয়োগের প্রস্তাব করেন।
‘জবান’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক তরুণ চিন্তক রেজাউল করিম রনি বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আর ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি দেখতে চায় না। যারা সরকারকে একটা হরিলুটের জিনিস মনে করে তাদেরকে মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা একটা নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্র দেখতে চায়। রাষ্ট্রের কাছে সবার পরিচয় শুধুমাত্র নাগরিক হিসেবে থাকবে। কোনো আদর্শের নামে, কোনো দলের নামে, জেলার নামে বিভক্তির রাজনীতি চায় না। তারা ফ্যানাটিক ডানপন্থা বা উগ্র বামপন্থার পরিবর্তে মধ্যপন্থার রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে।
হোস্ট প্যানেল থেকে সৈকত রুশদী বৈষম্য দূর করার জন্যে স্থায়ী কমিশন গঠন করার আহ্বান জানান।
ব্যারিষ্টার কামরুল হাফিজ সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে আরও সংগঠিতভাবে এরকম অনুষ্ঠান আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দর্শক–শ্রোতাদের মধ্য হতে প্রশ্নের মাধ্যমে মন্তব্য করেন শামসুল ইসলাম, আসমা আহমেদ, ড. কামাল ভুইয়া, মিনার আখতার চৌধুরী, গাজী সজল, মোস্তফা আকন্দ, ইমাম উদ্দিন ও সায়েম আহমেদ প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে আহমেদ শফিকুল হক বলেন ‘বাংলাদেশে শুধু পে কমিশনের সুপারিশগুলোই দ্রুত আলোর মুখে দেখে।’
তিনি বলেন বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মধ্যে একটা অসংগতি আছে। যেমন আমাদের দেশে আইন আছে, সংসদ আছে, দুদক আছে, অনেক রকম কমিশন আছে, তাদের কাজ করার কথা, গভর্নেন্স হার্ডওয়্যার ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা ঠিক আছে, কিন্তু সফটওয়্যার বা যারা এগুলোকে পরিচালনা করেন, সেটা এগুলোর সঙ্গে কনসিসটেন্ট নয়। ইনকম্পিটেবল হওয়ার কারণে অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানেরও ফলাফল দেখা যায় না।
তিনি কানাডার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভিন্নমতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমাদের প্রায়োরিটিতে সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এত সমস্যা, এত সংকট অথচ ডাকসু নির্বাচন এখন সব মিডিয়ার মনোযোগের প্রধান আকর্ষণ।
তিনি আরও বলেন, পার্লামেন্টে আইন হবে প্রথম ধাপ। কিন্তু প্রয়োগ হবে অনেক নিচু স্তরে। যেটার বাস্তবায়নের জন্যে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটাই হলো বড় কথা।
তিনি কানাডিয়ান সেন্টার ফর বাংলাদেশ ষ্টাডিজের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
সবশেষে সিসিবিএসের পরিচালক আব্দুল হালিম মিয়া সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের সংস্কার প্রস্তাবসূমহের কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের উপায় নিয়ে টরন্টোয় কানাডিয়ান সেন্টার ফর বাংলাদেশ ষ্টাডিজের (সিসিবিএস) উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট (শনিবার) টরন্টোর এগলিনটন স্কোয়ার পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে স্থানীয় সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কানাডার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান প্রফেসর ড. আহমেদ শফিকুল হক।
স্বাগত বক্তব্য দেন সিসিবিএসের পরিচালক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম মিয়া।
সেমিনারে ঢাকা থেকে ভার্চুয়্যালি যুক্ত হয়ে মুল প্রবন্ধ পাঠ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
অতিথি বক্তা ছিলেন কানাডার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির সোস্যাল সায়েন্সের প্রফেসর ড. সাদিকুল ইসলাম, কানাডার লেইকহেড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মাহফুজুল হক, সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কানাডার এলগোমা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. নুসরাত আজিজ, ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই দারুস সালামের প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ এবং লিডারশিপ ষ্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ।
হোস্ট প্যানেলে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সহযোগী অধ্যাপক ড. সাফি ভুইয়া, ব্যারিষ্টার কামরুল হাফিজ, মিডিয়া ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈকত রুশদী, সাবেক ছাত্রনেতা ও পিএইচডি অধ্যায়নরত সাহাবুদ্দিন লাল্টু।
সবিতা সোমানির সঞ্চালনায় সেমিনারটি সফলভাবে আয়োজনে সহযোগিতা করেন নাহিদ শরীফ, সামসুল ইসলাম ফায়সাল, নয়ন হাফিজ, ইউসুফ সেখ, তৌহিদ নুর ও গাজী সজল।
অনুষ্ঠানটি সরাসরি ধারণ করে প্রচার করে এনআরবি টেলিভিশন, যাত্রা টেলিভিশন ও প্রবাসী টেলিভিশন।
বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় অনলাইন জুমের মাধ্যমে কিনোট স্পিকার ড. হোসেন জিল্লুর রহমান তার বক্তৃতার শুরুতে এরকম একটি গুরুত্বপুর্ণ আয়োজনের জন্যে সিসিবিএসকে ধন্যবাদ জানান।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব আলোচনার আগে, আমাদের জানা দরকার, এই যে বহু মানুষের আত্মাহুতির মাধ্যমে চব্বিশের জুলাই– আগস্টে যে বিশাল রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন হলো, সেখানে সংস্কারের চাহিদাগুলো কী ছিল? চাহিদাগুলো আমাদের ভালো করে বোঝা দরকার। বর্তমান সময়ে সংস্কার প্রস্তাব আলোচনার যে পর্যায়ে আছে সেখানে পরিবর্তনের চাহিদার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে তা আমাদের বোঝা দরকার।
‘আগস্ট ২০২৪–এ যে সর্বজনীন একটা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল, তখনকার চাহিদা আসলে কী ছিল? চাহিদার ৩টি দিক ছিল—প্রথম চাহিদাটা ছিল, বিগত ১৫ বছরে যে কর্তৃত্ববাদী শাসন ছিল সেটার অবসান। কর্তৃত্ববাদী শাসন যখন আমরা বলি, তার স্তম্ভগুলো কী? কিসের ওপরে এগুলো তৈরি হয়েছে? ৪টি স্তম্ভের ওপরে এই ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন জগদ্দল পাথরের মতো বাংলাদেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছিল বলে আমি মনে করি।
‘প্রথম স্তম্ভটা হলো জবাদদিহিতার উর্ধে একটা প্রধান নির্বাহী। অতি ক্ষমতাশালী একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি ছিলেন সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধে, এই প্রধান নির্বাহীর একটা অবসান আমাদের সেই চাহিদার একটা ছিল। এটা ৪টি স্তম্ভের খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা স্তম্ভ।
‘দ্বিতীয় স্তম্ভ ছিল সেই জবাবদিহিতার উর্ধে প্রধান নির্বাহীর মতো আবার ছোট ছোট আঞ্চলিক যেটাকে আমি বলব এমপি–রাজ। প্রতিটা সংসদীয় আসনে এমপির অবস্থান ছিল অনেকটা প্রধান নির্বাহীর মতো, জবাবদিহিতার উর্ধ্বে যারা সবকিছুই কন্ট্রোল করেছে। সেটা স্হানীয় সরকার হোক, পুলিশ হোক, সবকিছুতে। কাজেই এই যে এমপি–রাজ, এই বিষয়টার একটা অবসান কিন্তু মানুষ চেয়েছে। কারণ কর্তৃত্ববাদী শাসনের এইটাও একটা বড় ধরনের স্তম্ভ।
‘তৃতীয় স্তম্ভ হলো আমাদের আমলাতন্ত্র। আমলা ও পুলিশ প্রশাসনের অতিমাত্রায় পার্টিজান ব্যবহার। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে দেওয়া, সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হয়তো এসপির সঙ্গে কথা বলছেন, এই যে চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে একটা যে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসিপ্লিন সেটা একেবারেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে কারও ইচ্ছের ওপর সবকিছু চলে। এই চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা, প্রাতিষ্ঠানিক নর্মসগুলো ফিরিয়ে এনে প্রতিস্থাপন করা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান যদি আমরা দেখতে চাই, এইটাও একটা গুরুত্বপুর্ণ স্তম্ভ।
‘চতুর্থ স্তম্ভ যেটা ছিল, আরবিটারিরি ডিটেনশন, মানে গুম–খুন ইত্যাদি। একটা ক্লাইমেট অব ফেয়ার তৈরি করা, যেটা একটা বড় ধরনের মানুষের মনের মধ্য ভয় ধরিয়ে দিয়ে দাবিয়ে রাখা। এগুলোই ছিল আমাদের ২০২৪–এ যে পরিবর্তন আমরা চাইছি তার অন্যতম একটা চাহিদা।
‘দ্বিতীয় যে চাহিদা ছিল, সেটাও খুবই গুরুত্বপুর্ণ, গত ১৫ বছর মানুষ সেই অর্থে তার নিজের প্রতিনিধিদের বেছে নিতে পারেনি। এক ধরনের স্বচ্ছন্দের ভিত্তিতে, একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচনী একটা আবহের মাধ্যমে। তাই অবশ্যই একটা ডেমোক্রেটিক ট্রানজিসন মানে একটা নির্বাচনের বিষয়টাও অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং সেটার জন্যে নির্বাচনী পরিবেশটাও নিশ্চিত করা, এটাও একটা গুরুত্বপুর্ণ চাহিদা।
‘তৃতীয় যে চাহিদা আমি উল্লেখ করব সংস্কৃতির একটা বিষয়, যে আমাদের একটা জাতীয় ঐক্যের একটা মুড এবং একটা ইনক্লুসিভ সোস্যাল এনভায়রনমেন্ট দরকার। মানে আমাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমুলক পরিবেশ না হলে একটা সামাজিক লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা খুব কঠিন। কাজেই সংস্কার চাহিদা বোঝাটা খুব জরুরি। বিভিন্ন বিষয়ে ১১টা সেক্টরাল কমিশন হয়েছে আপনারা জানেন। কিন্তু তার মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের ফোকাসটা একটু বেশি পড়েছে একটা জায়গার ওপর। সেটা হলো সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর। এর ওপরই তাদের সবচেয়ে বড় নজর আছে, কিন্তু সংস্কারের অবশ্যই আরও একটা বিষয় ছিল, সেটা হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির যে ভয়ানক ধ্বস নেমেছিল, সেটাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এখন আমি যদি দেখি কীভাবে সংস্কার প্রক্রিয়াটা এগিয়েছে, এই যে সামষ্টিক অর্থনীতির ধ্বস এটার জন্যে কিন্তু সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন হয় না। এটা প্রশাসনিক পদ্ধতিতেই এখানে পরিবর্তন আনা সম্ভব এবং সেখানে যথেষ্ট এক ধরনের শৃঙ্খলা অনেকটা আনা হয়েছে। কিন্তু আমি যত দূর দেখছি এ পর্যন্ত এই যে ঐকমত্য কমিশনের কথা বলি এবং সেখানে দেখুন মানুষের সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে এবং সেটা খুবই গুরুত্বপুর্ণ—অতি ক্ষমতায়িত প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টা খুব গুরুত্ব পেয়েছে। পার্লামেন্টের ধরন কী হবে, নির্বাচনের পদ্ধতি খুব গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে মানুষের চাহিদার অন্য বিষয় যেগুলো ছিল, স্থানীয় সরকারের সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, নারী বিষয়ক সংস্কার, এইগুলো কিন্তু সেরকম নজরের মধ্যে নেই। এগুলো এক অর্থে কমিশনের রিপোর্ট জমা হয়েছে, সেখানে প্রশাসনিকভাবে কিছু কিছু এগোচ্ছে বটে, কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের অন্যতম ফোকাস হচ্ছে সুনির্দিষ্টএকটা জায়গার মধ্যে সেটা হচ্ছে সাংবিধানিক বিষয়গুলো, নির্বাচনী বিষয়গুলো এবং সেই জন্যে আন্য যে বিষয়গুলো যেটা বলছিলাম, কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে অন্য স্তম্ভগুলো ঠিক ওইভাবে সংস্কারের আলোচনায় প্রাধান্য পায়নি। সেটা একটা সমস্যা হিসেবে আমি দেখছি ভবিষ্যতের জন্যে।
‘আরও একটি বিষয় হচ্ছে, সংস্কারের আলোচনার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ের যে বৈশিষ্ট, এখানে কিন্তু আলোচনাটা মুলত হচ্ছে যে দলগুলো আছে এবং ঐকমত্য কমিশন, তারা হয়তো অরগানাইজড কনসালটেসন করেছে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ায় এক ধরনের এলিটিজম আমরা দেখতে পেয়েছি। এই যে মানুষের সঙ্গে যে আলোচনার জায়গাগুলো, হয়তো তারা বলছে যে আমরা মাঠে গিয়ে কিছু আলোচনা করেছি। কিন্তু সংস্কার আলোচনা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে পুরো বিষয়টা এক ধরনের এলিটিস্ট বিষয়ের দিকে গেছে।
‘এখন আমি যদি শেষ বিষয়টা বলি, আপনাদের যে আগ্রহ আছে, যে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়? বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই আমরা ঐকমত্যের প্রক্রিয়া কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। জুলাই সনদ বললেও আমরা এখনো কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে আছি, সেপ্টেম্বরে ঢুকব, সো ওইখানে কিন্তু অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো এখনো রয়ে গেছে। বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ যদি আমি বলি, আমি কয়েকটা বলছি, আপনারা নিশ্চয়ই আরও অনেকগুলো দেখবেন, আপনাদের তরফ থেকে উঠে আসবে, একটি বিষয় হচ্ছে এখানে চাহিদার বিষয়ে এখনো ঐকমত্যের জায়গাটা সেই অর্থে তৈরি করা হয়নি বা হচ্ছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রাজুয়্যালি আমাদের এক ধরনের কনফ্রন্টেশনাল অ্যাটমসফেয়ার তৈরি হচ্ছে। সো ঐকমত্য কমিশন হয়তো অনেক চেষ্টা করেছে, প্রায় ৫–৬ মাস ধরে কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক খেলোয়াড় যারা আছেন, তাদের সঙ্গে যমুনায় বৈঠক করছে বটে। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনার দুর্বলতা যেটা দেখতে পাচ্ছি, ঐকমত্যের জায়গাটা এখনো সিকিউর করার ব্যপারে রাজনৈতিক সক্ষমতার একটা ঘাটতি দেখছি ঐকমত্য কমিশনের এবং সেই অর্থে অন্তর্বর্তী সরকারেরই।
‘অতএব সেখানে একটা অনিশ্চয়তার জায়গা রয়ে গেছে এবং আমরা আশা করব সেপ্টেম্বরে হলেও তারা হয়তো একটা জায়গায় পৌঁছুতে পারবে। কিন্তু গ্রাজুয়েলি যে বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো, কনফ্রনটেশনের যে বিষয়গুলো, এগুলো এক অর্থে দেখা যাচ্ছে যে, ছাড় দেবার তেমন কোনো মনোভাব নেই। ছাড় দেওয়া ছাড়াও আরও একটি বিষয় হলো, এই যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যেকোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এখানে কিন্তু এক ধরনের রিজিড একটা আলোচনা হচ্ছে। জনগণের বিষয়টা আলোচনা হচ্ছে কি না। ফর্মুলা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু মানুষতো একটা উত্তরণ চায়। উত্তরণটা তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কিন্তু এখানে ফর্মুলাভিত্তিক রিজিডিটিতে আটকে থাকার সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সো এই যে ঐকমত্য তৈরির যে জায়গাটা, আপনারা যে বাস্তবায়নের কথা বলছেন, বাস্তবায়নের আগে প্রথম বিষয়টি যে ঐকমত্য প্রক্রিয়ার একটা সমাপ্তি টানা, এইটা কিন্তু এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েই যাচ্ছে এবং তা আরও গাঢ় হচ্ছে। তবে আমরা আশা করব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আমরা দেখাতে পারব।
‘আর একটা বিষয় দেখছি, সার্বিক আলোচনাটা। এই যে আপনি আমাদের ঐকমত্য তৈরির, সংস্কারের একটা জায়গায় নিয়ে আসা, এখানে কিন্তু যেভাবে জিনিষটা এগিয়েছে, সেটা এক ধরনের ফর্মুলা সলিউশনের দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়েছে, জাতীয় ঐক্যমত্য তৈরির একটা মুড তৈরির কাজটা কিন্তু সমান্তরালভাবে হয়নি। সেই মুডটা না থাকার ফলে কনফ্রন্টেশনের বিষয়টা আরো বেশি এগোচ্ছে।
‘আমি শেষ করব এটা বলে যে, বাস্তবায়নের অন্যতম আরও একটা ঘাটতি হলো অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বৈশিষ্ট তাদের খুব নজরে এসেছে এবং সেটা বলা যায়, একটা দুর্বলতা হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেটা অনেক কিছুতে হচ্ছে। যখন আমরা সরকার শব্দটা ব্যবহার করি, সরকার একটা হচ্ছে তার একটা তো ভিত্তি আছে, তার আইনি একটা ম্যান্ডেট আছে, কিন্তু আপনারা কানাডার কথাও বলছিলেন, কিন্তু ম্যান্ডেট হ্যাস টু বি এক্সারসাইজড, পাওয়ার হ্যাজ টু বি এক্সারসাইজড, রিসপনসিবিলিটি হ্যাজ টু বি এক্সারসাইজড, এই এক্সারসাইজড হওয়ার যে বিষয়টা, সেখানে আমরা কিন্তু বেশ বড় ধরনের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এখানে রিঅ্যাক্টিভ বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। তো সার্বিক বিষয়ে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি যে চাহিদার কথাটা আমি প্রথমেই উচ্চারণ করলাম এই জন্যে যে, আগস্টে যে পরিবর্তনটা হলো, এই চাহিদা কিন্তু মানুষের হৃদয়ের মধ্যে গভীরভাবে বসে আছে। তারা একটা সুস্থ উত্তরণ চায়, অর্থনীতির একটা নুতন ভিত্তি তৈরি হোক সেটা চায়। গণতান্ত্রিকভাবে তারা কর্তৃত্ববাদী শাসনের সব পিলারগুলোর অবসান চায়। কিন্তু সেটা করার জন্যে তারা একটা যে প্রক্রিয়া, বিশেষ করে যে রাজনৈতিক খেলোয়াড়েরা মাঠে আছেন তাদেরকে একত্রিত করার, তাদেরকে এক জায়গায় নিয়ে আসার যে সক্ষমতা। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের খুব গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব। সেই চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু রয়েই গেছে। ওই মুহূর্তেই আমরা রয়ে গেছি। আমরা আশা করব, আমাদের আকাঙ্খার এই সদিচ্ছা, মানুষের হতাশা যতই থাকুক না কেন, মানুষের সেই চাহিদাগুলো কিন্তু এখনো আছে। বাংলাদেশের যে বিশাল সম্ভাবনা আছে, মানুষ, আমাদের যে পরিশ্রমী মানুষ, এতকিছুর মধ্যেও অর্থনীতির চাকাটা কিন্তু চালিয়েই যাচ্ছে সেই সাধারণ মানুষেরা, সেই কৃষকেরা, সেই সাধারণ ভোক্তারা, সেই নারীরা, সেই তরুণেরা সেই চাহিদার প্রতি আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের সেই চাহিদার প্রতি জোরালোভাবে নজর দেওয়াটা দরকার। যাতে করে ২০২৫ সালের বাদবাকি যে সময়টা আছে, সুষ্ঠুভাবে যেন একটা সমাধানের দিকে আমরা এগোতে পারি।’
হোসেন জিল্লুর রহমানের বক্তব্য শেষে হোস্ট প্যানেল থেকে সাবেক ছাত্রনেতা সাহাবুদ্দিন লাল্টু তাঁর কাছে জানতে চান কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসানকল্পে তিনি যে জাতীয় ঐক্যমত আশা করেছেন অথবা গণঅভ্যুত্থানের ষ্টেক হোল্ডারদের মধ্যে একটা ঐক্য চেয়েছেন, তা কীভাবে অর্জন করা সম্ভব?
হোসেন জিল্লুর রহমান এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে সেমিনারে উপস্থিত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এর উত্তর পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কানাডার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সাদিকুল ইসলাম কয়েক বছর আগের ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করে সংস্কার দরকার। ৫৪ শতাংশ মানুষ রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। দুনিয়ার যেখানেই রেভ্যুলেশন হয়েছে বা রিফর্ম হয়েছে সবজায়গাতেই রাজনীতিবিদরা গুরুত্বপুর্ণ ও প্রধান ভুমিকা পালন করেন। কিন্তু সেই ভুমিকাটা যদি মিসিং হয় তাহলে কী হয়? এর উত্তরে তিনি মানুষের হিউম্যান ন্যাচার বোঝার ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, হিউম্যান ন্যাচার তৈরি হয় নিজ স্বার্থ ও সহানুভুতি থেকে। যে দেশে বিশাল অসমতা রয়েছে সেখানে ঐক্য সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ৩০ লাখ শিশু রাস্তায় বাস করে। লেবার রাইটসে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের মধ্যে একটি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব জায়গায় বিশাল অসমতা। ১০–১২ বছরের শিশুরা স্কুলে না গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। কানাডায় বসে আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের কাজকর্মকে আমরা কানাডায় বসে মনিটর করতে পারি, টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে ভয়েস রেইজ করতে পারি।
সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, জাতীয় ঐকমত্যকে দেখিয়ে বাংলাদেশ এক সময় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল। ভিন্নমতেরও একটা সৌন্দর্য রয়েছে। কাজেই ভিন্নমতকেও আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তিনি সেমিনারের স্বাগতিক বক্তা আব্দুল হালিম মিয়ার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ আর্টিকেলে আছে, জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার আর্টিকেল ৩২–এ এবং গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ আর্টিকেল ৩৩–এ রয়েছে।
তিনি বলেন, এই জিনিষগুলো পরিবর্তনের জন্য যে মনোজগত তৈরি হয়েছে তা যদি সত্যিই পরিবর্তন করতে চাই তাহলে শুধু রাজনীতিবিদদের দিয়ে যেমন হবে না, শুধু আমলাদের দিয়ে হবে না, শুধু একাডেমিকদের দিয়ে হবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে এখন চলছে চরম অস্থিরতা, কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। সংস্কারের বিষয়ে যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে সেটুকু নিয়েই আমাদের আপাতত এগিয়ে যেতে হবে। আর বাকিগুলো পরবর্তী সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
কানাডার লেইকহেড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে একটা গণবিপ্লব হয়েছে।
তিনি দার্শনিক অ্যারিষ্টটলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কোনো সমাজে যদি বৈষম্য বিরাজ করে তবে সেখানে বিপ্লব হবে। কার্ল ডেভিস বলেছেন, কোনো সমাজে যদি আশা এবং পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য থাকে তাহলে সেখানে বিপ্লব হয়। আর সম্প্রতি কেন রিংগটন নামে একজন তাত্বিক বলেছেন যদি আপেক্ষিক বঞ্চনা বিরাজ করে তবে সেই সমাজে বিপ্লব হবে। একটা বিপ্লব হয় গ্রাম থেকে, আর একটি বিপ্লব হয় শহর থেকে। যদি বিপ্লবটা একেবারে নিচু থেকে হয় তবে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর যদি বিপ্লবটা যদি কেন্দ্র থেকে হয় তবে এই বিপ্লবের ফলাফল হবে এলিট একোমোডেশন। বাংলাদেশে সংস্কার প্রস্তাবসুমহ চার রকমভাবে সফল বাস্তবায়ন হতে পারে: গণভোট, নির্বাহী আদেশে প্রক্লেমশন, সংবিধান সংশোধন, নুতন করে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চালু হলে তা খুবই খারাপ নজির তৈরি হবে বাংলাদেশের জন্যে।
সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, এত দলের ডাকার প্রয়োজন ছিল না। যারা সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা আছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই হয়ে যেত। কারণ এমন সব ব্যক্তিকেও ডাকা হয়েছে যাদের পেছনে ১০ জন লোকও নেই।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, কেন দেশে বারবার সামরিক শাসন আসে? কেন বারবার অভ্যুত্থান হয়? বাংলাদেশে দরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।
তিনি সংস্কার প্রস্তাবসুমহবাস্তবায়নের জন্যে সকল মহলের আন্তরিকতার ওপর গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশ সরকারের শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মাহফুজুল হক শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি শ্রমের মর্যাদা দিতে সকলকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, একজন রিকশাচালককেও তুই তোকারি করা যাবে না।
মাহফুজুল হক সকল দলের মেনিফেস্টোতে সংস্কার প্রস্তবাসমূহ সংযোজনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে এগুলো থাকলে তাদেরকে নির্বাচন পরবর্তী চাপ দেওয়া সম্ভব হবে যদি বাস্তবায়নে তারা গড়িমসি করেন।
কানাডার আলগোমা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নুসরাত আজিজ বলেন, বর্তমান প্রজন্ম এআই প্রজন্ম। এ প্রজন্মের জন্য অনেক কিছু নুতন করে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ প্রজন্মটাই নতুন প্রজন্ম। তাদের থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের অবশ্যই ইনক্লুসিভ এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রিফর্মের যেগুলো প্রস্তাব সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
নুসরাত আজিজ কানাডা আমেরিকার পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির উদাহরণ দিয়ে বলেন, তারা মিনিষ্ট্রির টাকা খরচের জবাবদিহিতা আদায় করে নেন।
তিনি বাংলাদেশের পার্লামেন্টের সংসদীয় কমিটিগুলোতে বিরোধী দলীয় সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান।
তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিটিগুলোতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ লোকদের নিয়োগের প্রস্তাব করেন।
‘জবান’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক তরুণ চিন্তক রেজাউল করিম রনি বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আর ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি দেখতে চায় না। যারা সরকারকে একটা হরিলুটের জিনিস মনে করে তাদেরকে মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা একটা নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্র দেখতে চায়। রাষ্ট্রের কাছে সবার পরিচয় শুধুমাত্র নাগরিক হিসেবে থাকবে। কোনো আদর্শের নামে, কোনো দলের নামে, জেলার নামে বিভক্তির রাজনীতি চায় না। তারা ফ্যানাটিক ডানপন্থা বা উগ্র বামপন্থার পরিবর্তে মধ্যপন্থার রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে।
হোস্ট প্যানেল থেকে সৈকত রুশদী বৈষম্য দূর করার জন্যে স্থায়ী কমিশন গঠন করার আহ্বান জানান।
ব্যারিষ্টার কামরুল হাফিজ সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে আরও সংগঠিতভাবে এরকম অনুষ্ঠান আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দর্শক–শ্রোতাদের মধ্য হতে প্রশ্নের মাধ্যমে মন্তব্য করেন শামসুল ইসলাম, আসমা আহমেদ, ড. কামাল ভুইয়া, মিনার আখতার চৌধুরী, গাজী সজল, মোস্তফা আকন্দ, ইমাম উদ্দিন ও সায়েম আহমেদ প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে আহমেদ শফিকুল হক বলেন ‘বাংলাদেশে শুধু পে কমিশনের সুপারিশগুলোই দ্রুত আলোর মুখে দেখে।’
তিনি বলেন বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের মধ্যে একটা অসংগতি আছে। যেমন আমাদের দেশে আইন আছে, সংসদ আছে, দুদক আছে, অনেক রকম কমিশন আছে, তাদের কাজ করার কথা, গভর্নেন্স হার্ডওয়্যার ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা ঠিক আছে, কিন্তু সফটওয়্যার বা যারা এগুলোকে পরিচালনা করেন, সেটা এগুলোর সঙ্গে কনসিসটেন্ট নয়। ইনকম্পিটেবল হওয়ার কারণে অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানেরও ফলাফল দেখা যায় না।
তিনি কানাডার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভিন্নমতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমাদের প্রায়োরিটিতে সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এত সমস্যা, এত সংকট অথচ ডাকসু নির্বাচন এখন সব মিডিয়ার মনোযোগের প্রধান আকর্ষণ।
তিনি আরও বলেন, পার্লামেন্টে আইন হবে প্রথম ধাপ। কিন্তু প্রয়োগ হবে অনেক নিচু স্তরে। যেটার বাস্তবায়নের জন্যে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেটাই হলো বড় কথা।
তিনি কানাডিয়ান সেন্টার ফর বাংলাদেশ ষ্টাডিজের পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
সবশেষে সিসিবিএসের পরিচালক আব্দুল হালিম মিয়া সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের সংস্কার প্রস্তাবসূমহের কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের উপায় নিয়ে টরন্টোয় কানাডিয়ান সেন্টার ফর বাংলাদেশ ষ্টাডিজের (সিসিবিএস) উদ্যোগে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ফ্রান্সের লুতখুজু শহরের মেয়র ডেভিড মার্টিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির রিকশা রেপ্লিকা উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশি সাংবাদিক, গবেষক ও সামাজিক কর্মী শাহাবুদ্দিন শুভ।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে পিঠা উৎসব। রোববার (৩১ আগস্ট) বিকেলে কুয়ালালামপুরে জি-টাওয়ার হোটেলের হলরুমে অনুষ্ঠিত এই পিঠা উৎসবে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অংশ নেন বিভিন্ন পেশার প্রবাসীরা।
মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে বিডি এক্সপ্যাটস ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছে।