logo
সুপ্রবাস

ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা

সহিদুল আলম  স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
সহিদুল আলম স্বপন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড১৫ মে ২০২৫
Copied!
ওই আকাশে লুকিয়ে আছে মা
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকের কথা। তখন সুইস কোম্পানি ফাদসা এস এ–তে চাকরি করি। হঠাৎ এক দিন কোম্পানির মালিক মশিউয়্যু মিশেল লাসের (বাংলায় জনাব মিশেল ল্যাসার) তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। আমিতো ভয়ে দিশেহারা, ভাবলাম ফ্রেন্স ভাষা না জানার কারণে আমার মনে হয় এবার চাকরিটাই গেল।

বলে রাখা ভালো, সুইজারল্যান্ডের ৪টি সরকারি ভাষার (ফরাসি, সুইস জার্মান, ইতালিয়ান এবং রোমন্স—রোমান নয়) মধ্যে জেনেভা ফরাসি ভাষাভাষী।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ভ্যানিশিং ক্রিমের পাবলিসিটি ছিল-ম্যানোলা সিবোঁ ভ্যানিশিং ক্রিম নিয়ে এলো ফরাসি সৌরভ। পরে জেনেছি সিবোঁ ফরাসি শব্দ। যার অর্থ খুব ভালো (হয়তো বাংলায় বোঝাতে চেয়েছেন সুগন্ধময়)। আর এটাই শুধু আমার ফরাসি ভাষার ভান্ডার।

যাই হোক, ভয়ে ভয়ে মশিউয়্যু মিশেল লাসের খাস কামরায় হাজির হলাম। দেখি কামরায় সোফার এককোণে প্যাট্রিক (আমার সুইস সহকর্মী এবং আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে) আর এইচআর হেড লরেতা মার্টিনি বসে আছে। বুঝতে আর দেরি হলো না, এখনি বস বলবেন, ইউ আর ফায়ার এবং প্যাট্রিককে তোমার সব কাজগুলো বুঝিয়ে দাও।

কোথায় ফায়ার তা না বলে মশিউয়্যু লাসের বললেন মাই ডিয়ার, আগামী সপ্তাহে প্যাট্রিক আর তুমি (আমি আলম) তোমরা দুজনে রটারডাম যাচ্ছো ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিংয়ের জন্য। আলম তুমি কাল ভোরে বার্ণ (সুইজারল্যান্ডের রাজধানী) যাবে নেদারল্যান্ডসের ভিসা করাতে। লরেতা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে।

লেখকের মা
লেখকের মা

বলে রাখা ভালো তখনো আমি সুইস নাগরিক হয়ে উঠিনি। আর মশিউয়্যু মিশেল লাসেরই আমাকে সুইজারল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

রটারডাম উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর (আমস্টারডামের পরেই)। এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণ হল্যান্ড প্রদেশে, উত্তর সাগরের তীরে, রাইন নদীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দর শহরকে প্রায়শই ‘ইউরোপের প্রবেশদ্বার’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তো যেই কথা সেই কাজ। সমস্ত আনুষ্ঠিকতা শেষে সপ্তাহান্তে কেএলএম রয়্যাল ডাচ এয়ারলাইনসে চেপে জেনেভা থেকে আমস্টারডামের শিফল বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। আমস্টারডাম শিফল বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে রটারডাম সেন্ট্রাল ট্রেন ষ্টেশনে এসে নামলাম। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে সরাসরি রটারডাম ম্যারিয়ট হোটেলে।

রটারডাম স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট, ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি (আরএসএম) ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিসনেস স্কুলগুলোর মধ্যে একটি। এখানেই আমাদের কোর্স। বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝে সময়ের ৪–৫ ঘন্টার পার্থক্য। প্রতিদিন বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়। বাবা আমার জ্ঞানের পাগল। ৬০ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

কিন্তু বাবা–মা দুজনের কেউ মানতে পারছিলেন না আমি বিদেশে থাকি। দেশে থাকতে মায়ের আহাজারিতে বাবা বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশ মিলিাটারি একাডেমি থেকে আমায় ছাড়িয়ে এনেছিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মাকে ফোন করে ঘুমাই। বরাবরের মতে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মার সঙ্গে কথা বলছি।

মা আমার প্রাইমেরির গন্ডি পেরুনো। কিন্তু শিক্ষার প্রতি তার পরম শ্রদ্ধা। গান-নাটক সংস্কৃতির পাগল আমি। মা আমায় প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করেন কেমন চলছে গান-বাজনা। অনেকগুলো নূতন গানের ক্যাসেট কিনে রেখেছেন তিনি। বিশেষ করে নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, অজয় চক্রবর্তী, মেহেদী হাসান আর জগজিৎ সিং–এর (আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী)। সুইজারল্যান্ডে ফিরলেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দেবেন। আমার প্রিয় কুমিল্লার খদ্দরের হাওয়াই শার্টসহ। আরও কত কথা। শেষ হয়েও হয় না শেষ। মায়ের প্রতিটি কথায় এক অনুপ্রেরণা।

লেখক
লেখক

সেদিন ছিল বাংলাদেশে শেষ রোজা। পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার রোজার ঈদ। পরদিন ক্লাস নেই, ভেবে রেখেছি সকালে ব্রেকফাস্ট না করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে ফ্রেস হয়ে তারপর সারাদিন ঘুরে বেড়াব, দেখব বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী বন্দর, রটারডাম চিড়িয়াখানা, রিমাস্টারড ডিজিটাল আর্ট অডিওভিজ্যুয়াল, ইউরোমাস্ট টাওয়ার, কিউব হাউস ইত্যাদি আর রাতে যাবে বাইয়্যাবিচ ক্লাবে নাচতে।

সেদিন আকাশটা অঝোর ধারায় কাঁদছে। হোটেল রুমের সাইড টেবিলে রাখা ফোনটাও সাতসকালেই সেদিন চিৎকার করে কান্না করে চলেছে, ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং…।

ফোনটা যেন পাগল হয়ে গেছে। বিরক্ত হয়েই মিনিট খানেক পর আধো বোঁজা চোখে ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বললাম, হোয়াট দ্য হেল প্যাট্রিক, লেট মি গেট সাম স্লিপ। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ভাইয়া আমি ফরিদ (আমার ছোট বোন পান্নার বর), এক নি:শ্বাসে বলে চলছে, ভাইয়া আমরা এইমাত্র কবরস্তান থেকে আসলাম। সব কিছুই ঠিক ছিল, দাফন-কাফন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কেঁদে আর কী করবেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। এই যে আব্বার সঙ্গে কথা বলেন, আম্মাতো কাউকে কষ্ট দেননি। আল্লাহর কাছে আম্মার রুহের মাগফিরাত কামনা করে নামাজ পড়ুন যেন ওনাকে আল্লাহ জান্নাতে স্থান করে দেন। চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে আমি আজও প্রতিনিয়ত গেয়ে চলছি—‘সবাই বলে, ওই আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখ, পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে রাতের তারা, আমায় কি তুই বলতে পারিস কোথায় আছে, কেমন আছে মা? ভোরের তারা, রাতের তারা, মা-কে জানিয়ে দিস অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারি নাI’

আরও পড়ুন

কুয়েতে ভিসা দালালদের দৌরাত্ম্য কমেছে

কুয়েতে ভিসা দালালদের দৌরাত্ম্য কমেছে

কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যকর উদ্যোগের ফলে ভিসা দালালদের সিন্ডিকেটে ধস নেমেছে। এতে অসাধু নিয়োগকর্তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে লাগাম পড়েছে।

৯ ঘণ্টা আগে

বাহরাইনের ঈসা টাউন এলাকায় প্রবাসীদের জন্য মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্প

বাহরাইনের ঈসা টাউন এলাকায় প্রবাসীদের জন্য মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্প

বাহরাইনের বাংলাদেশ দূতাবাস গতকাল শুক্রবার (১ আগষ্ট) ঈসা টাউনের একটি কমিউনিটি সেন্টারে বাহরাইনের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অংশগ্রহণে প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ সচেতনতামূলক মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্পের আয়োজন করে।

২১ ঘণ্টা আগে

গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যের আহ্বান রাষ্ট্রদূত মুশফিকের

গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যের আহ্বান রাষ্ট্রদূত মুশফিকের

গণতন্ত্রবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী। তিনি বলেন, বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে পালিয়ে থাকা চক্র এখনো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে।

১ দিন আগে

রিয়াদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদ্‌যাপন

রিয়াদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদ্‌যাপন

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে বিভিন্ন কর্মসুচির মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসের প্রথম বার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে গতকাল শুক্রবার (৩১ জুলাই) রিয়াদে দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে ‘জুলাই বিয়ন্ড বর্ডারস’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

১ দিন আগে